পায়ের মাংসপেশিতে ব্যথা কমানোর উপায়, কারণ ও কেন হয়?

পায়ের মাংসপেশিতে ব্যথা কমানোর উপায়, কারণ ও কেন হয়?

আপনার পায়ে ব্যথা হচ্ছে? একা নন আপনি। অনেকেই দিনের শেষে বা ব্যায়ামের পর পায়ের মাংসপেশিতে ব্যথা অনুভব করেন। এই ব্যথা কখনো কখনো জীবনযাত্রাকে বিঘ্নিত করতে পারে। কিন্তু চিন্তা করবেন না, এই ব্লগ পোস্টে আমরা পায়ের মাংসপেশিতে ব্যথা কমানোর উপায়, কেন হয় এবং এর থেকে মুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।

পায়ের মাংসপেশিতে ব্যথা কেন হয়?

পায়ের মাংসপেশিতে ব্যথা কেন হয়?

পায়ের মাংসপেশিতে ব্যথা হওয়া খুবই সাধারণ একটি সমস্যা। আমরা অনেক সময়ই এর কারণ বুঝতে পারি না, তবে এটা অনেক কারণে হতে পারে। এই ব্যথা কখনও হালকা হয়, আবার কখনও খুব যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে। আসুন আমরা জানি, কেন এমন হয়?

 অতিরিক্ত কাজ বা পরিশ্রম

যদি আপনি একটানা অনেকক্ষণ হাঁটেন, দৌড়ান বা ভারী কাজ করেন, তাহলে মাংসপেশি ক্লান্ত হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত ব্যবহার করলে মাংসপেশির ওপর চাপ পড়ে, এতে পেশি দুর্বল হয়ে ব্যথা শুরু হয়।

পানি কম খাওয়া

আমাদের শরীরের ৭০% অংশই পানি দিয়ে তৈরি। যদি শরীরে পানির অভাব হয়, তাহলে মাংসপেশি শক্ত হয়ে যায় এবং ব্যথা শুরু হয়। সারাদিন পর্যাপ্ত পানি না খেলে শুধু মাংসপেশি নয়, শরীরের অন্যান্য অঙ্গও ঠিকমতো কাজ করতে পারে না।

মানসিক চাপ

যদি আপনার মাথায় অনেক চিন্তা থাকে বা মানসিক চাপ কাজ করে, তাহলে এর প্রভাব শরীরেও পড়ে। মানসিক চাপের কারণে পেশি শক্ত হয়ে যায় এবং তাতে ব্যথা হয়। যাঁরা দীর্ঘদিন মানসিক চাপে থাকেন, তাঁরা প্রায়ই মাংসপেশির ব্যথায় ভোগেন।

আঘাত বা চোট

কখনও কখনও পড়ে গেলে, পা মচকে গেলে বা ভারী কিছু পায়ে পড়ে গেলে মাংসপেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে পেশি ফুলে যায় এবং ব্যথা হয়।

পুষ্টির অভাব

পেশি শক্তিশালী রাখতে আমাদের শরীরে পুষ্টি থাকা খুব দরকার। ভিটামিন ডি, ক্যালসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের মতো উপাদান মাংসপেশির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভিটামিন ডি মূলত সূর্যের আলো থেকে পাওয়া যায়। এছাড়া মাছ, ডিম, দুধ, মাখন এবং মাশরুমে এই ভিটামিন থাকে। যদি শরীরে পুষ্টির ঘাটতি হয়, তাহলে পেশিতে ব্যথা হতে পারে।

ঘুমের অভাব

ঘুমের অভাব

যদি আপনি প্রতিদিন পর্যাপ্ত না ঘুমান, তাহলে আপনার শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ঘুম আমাদের শরীরের পুনর্গঠনের জন্য খুবই জরুরি। 

খিঁচুনি বা ক্র্যাম্প

মাংসপেশি যখন হঠাৎ শক্ত হয়ে যায়, তখন একে খিঁচুনি বলা হয়। এটি খুব যন্ত্রণাদায়ক। সাধারণত দীর্ঘক্ষণ একভাবে বসে থাকা, বেশি কাজ করা বা শরীরে পানির অভাবে এমনটা হয়।

ভুল জুতা পরা

আপনার জুতা যদি সঠিক মাপের না হয় বা আরামদায়ক না হয়, তাহলে পায়ের মাংসপেশিতে চাপ পড়ে। এর ফলে পেশি ব্যথা হতে পারে।

বিভিন্ন রোগের প্রভাব

ডেঙ্গু, ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লু এর মতো ভাইরাসজনিত অসুখে অনেক সময় মাংসপেশিতে ব্যথা হয়। এছাড়া বাতরোগ, ডায়াবেটিস, কিডনির সমস্যা বা লুপাসের মতো রোগও মাংসপেশিকে দুর্বল করে। এতে পেশি ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।

পায়ের মাংসপেশিতে ব্যথা হওয়ার কারণ

পায়ের মাংসপেশিতে ব্যথা হওয়ার কারণ

৩৮ বছর বয়সী সমীর সিনহা প্রতিদিন সকালে হাঁটতে গিয়ে পায়ের পেছনের মাংসপেশিতে ব্যথা অনুভব করতেন। একটু জোরে হাঁটলেই ব্যথা বেড়ে যেত, তবে বসে পড়লে ব্যথা কমে যেত। এই সমস্যায় চিন্তিত হয়ে তিনি একদিন ডাক্তার দেখালেন। ডাক্তার কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর জানান যে, সমীর পেরিফেরাল আর্টারিয়াল ডিজিজ (পিএডি) এ আক্রান্ত। এটি একটি সমস্যা যেখানে পায়ের রক্ত সরবরাহকারী ধমনী সরু বা ব্লক হয়ে যায়। ভাগ্য ভালো, সময়মতো ডাক্তার দেখানোর কারণে সমীরের অবস্থা গুরুতর হওয়ার আগেই চিকিৎসা শুরু হয়।

অনেকে হার্ট অ্যাটাক সম্পর্কে জানে, কিন্তু লেগ অ্যাটাকের ব্যাপারে আমরা কমই সচেতন। পায়ের রক্ত সঞ্চালনে বাধা সৃষ্টি হলে পেছনের মাংসপেশি বা উরুতে ব্যথা হয়। যদি ব্লক বড় হয়, তবে ব্যথা ক্রমাগত তীব্র হয়, পায়ের আঙ্গুল কালো হয়ে যেতে পারে, এমনকি গ্যাংগ্রিনও হতে পারে। বিশেষ করে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ বা ধূমপানের অভ্যাস থাকলে এ ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

যদি ৫০০ মিটারের কম হাঁটলেই পায়ের ব্যথা হয়, তাহলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এর সঙ্গে ত্বক শুকিয়ে যাওয়া বা পায়ের লোম পড়ে যাওয়ার মতো লক্ষণও থাকতে পারে। তবে জীবনযাপনে কিছু সহজ পরিবর্তন এই সমস্যার ঝুঁকি কমাতে পারে। নিয়মিত হাঁটাহাঁটি, সাইকেল চালানো, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা এবং মানসিক চাপ কমানো এসবই আপনার পা এবং শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে। 

পায়ের মাংসপেশিতে ব্যথা কমানোর উপায়

পায়ের মাংসপেশিতে ব্যথা কমানোর উপায়

ভুলভাবে হাঁটাচলা, অতিরিক্ত কাজ বা অনিয়মিত জীবনযাপন এর জন্য পায়ের মাংসপেশিতে ব্যথা হয়। তবে ঘরোয়া কিছু উপায় মেনে চললে এই ব্যথা সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। নিচে বিস্তারিত কিছু পদ্ধতি তুলে ধরা হলো:

১. পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন

ব্যথা হলে পেশিকে সময় দিন সেরে ওঠার। অতিরিক্ত কাজ বা হাঁটাচলা পেশিকে আরও বেশি ক্লান্ত করে দেয়। প্রথমে যতটুকু সম্ভব চলাফেরা এড়িয়ে চলুন। পরে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক কাজে ফিরে যান। বিশেষ করে, যাঁরা ব্যায়াম শুরু করেছেন, তাঁদের ধীরে ধীরে ব্যায়ামের সময় এবং তীব্রতা বাড়ানো উচিত।

২. গরম পানির সেঁক দিন

গরম সেঁক ব্যথা কমানোর জন্য খুব কার্যকর। এটি পেশির রক্ত চলাচল বাড়ায় এবং ব্যথা কমায়। একটি পরিষ্কার কাপড়ে গরম পানি ভিজিয়ে ব্যথার জায়গায় কিছুক্ষণ ধরে রাখুন। প্রতিদিন কয়েকবার এটি করলে আরাম পাবেন।

বরফ সেঁক করুন

৩. বরফ সেঁক করুন

যদি পায়ের ব্যথা আঘাতজনিত কারণে হয়, তবে বরফ সেঁক খুবই উপকারী। একটি পাতলা কাপড়ে বরফ পেঁচিয়ে ৫-১০ মিনিটের জন্য ব্যথার জায়গায় লাগান। এটি পেশির প্রদাহ কমায় এবং ব্যথা দ্রুত কমাতে সাহায্য করে।

৪. নরম ও আরামদায়ক জুতা ব্যবহার করুন

ভুল ধরনের জুতা ব্যবহারের কারণে পায়ের পেশিতে ব্যথা হতে পারে। সবসময় এমন জুতা পরুন, যার সোল নরম এবং আরামদায়ক। এতে পায়ের ওপর চাপ কম পড়ে এবং ব্যথা থেকে মুক্তি মেলে।

৫. লবণ-পানির সেঁক

গরম পানিতে লবণ মিশিয়ে সেই পানি দিয়ে পা ভিজিয়ে রাখুন। ১৫-২০ মিনিট ভিজিয়ে রাখলে পেশির শিথিলতা বাড়ে এবং ব্যথা কমে। নিয়মিত এটি করলে পেশির ব্যথা দ্রুত ভালো হয়।

৬. হালকা ব্যায়াম ও স্ট্রেচিং করুন

স্ট্রেচিং বা হালকা ব্যায়াম পেশি মজবুত ও নমনীয় করে। সকালে বা সন্ধ্যায় হাঁটা, যোগব্যায়াম বা সাধারণ স্ট্রেচিং করলে পায়ের পেশি আরও শক্তিশালী হয়। তবে ব্যথা থাকলে ভারী ব্যায়াম এড়িয়ে চলুন।

তেল মালিশ করুন

৭. তেল মালিশ করুন

ক্যাস্টর তেল বা লবঙ্গ তেল দিয়ে ব্যথার জায়গায় হালকাভাবে মালিশ করুন। ক্যাস্টর তেলে থাকা ভিটামিন ই, প্রোটিন এবং অন্যান্য খনিজ উপাদান পেশিকে আরাম দেয়। লবঙ্গ তেলের অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি গুণ ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।

৮. ঠান্ডা ও গরম পানির চিকিৎসা (কনট্রাস্ট বাথ)

একটি গামলায় ঠান্ডা পানি এবং আরেকটিতে গরম পানি নিন। প্রথমে পা ঠান্ডা পানিতে ৫ মিনিট রাখুন, তারপর গরম পানিতে ৫ মিনিট ডুবিয়ে রাখুন। এটি রক্ত চলাচল বাড়িয়ে দ্রুত আরাম এনে দেয়।

৯. পুষ্টিকর খাবার ও পানি পান করুন

পর্যাপ্ত পানি পান করলে শরীরে ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য বজায় থাকে, যা পেশির কার্যক্রমের জন্য জরুরি। এছাড়া ভিটামিন ডি, ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়ামসমৃদ্ধ খাবার যেমন ডিম, দুধ, কলা এবং শাকসবজি খেলে পেশির শক্তি বাড়ে।

১০. রাইস পদ্ধতি অনুসরণ করুন

“রাইস” বলতে বুঝায়:

  • রেস্ট (Rest): বিশ্রাম নিন, পেশিকে আরাম দিন।
  • আইস (Ice): বরফ ব্যবহার করুন ব্যথার জায়গায়।
  • কম্প্রেশন (Compression): ব্যথার স্থান কোনো কাপড় দিয়ে হালকা করে বেঁধে রাখুন।
  • এলিভেশন (Elevation): পা হৃদযন্ত্রের উচ্চতার ওপরে তুলে রাখুন।

১১. দীর্ঘস্থায়ী ব্যথায় বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন

যদি পায়ের মাংসপেশির ব্যথা কয়েকদিনের মধ্যে কমে না, তাহলে ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করুন। ব্যথার প্রকৃতি অনুযায়ী বিশেষ ধরনের থেরাপি বা ব্যায়াম প্রয়োজন হতে পারে।

১২. অ্যাপেল সিডার ভিনেগার ব্যবহার করুন

গরম পানিতে কয়েক চামচ অ্যাপেল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে পা চুবিয়ে রাখুন। এতে পায়ের মাংসপেশি শিথিল হবে এবং ব্যথা দ্রুত কমে যাবে।

 

বিস্তারিত জানুন: বুকের ব্যথা কেন হয়? বুকে ব্যথা হলে করণীয় কি?

 

সাধারণ জিজ্ঞাসা

করণীয়

  • পায়ে ব্যথা ও সামান্য ফোলা থাকলে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন। শোয়ার সময় পায়ের নিচে একটি বালিশ রাখুন।
  • বসে কাজ করার সময় পা কিছুটা উঁচুতে রাখার চেষ্টা করুন।
  • ব্যথার স্থানে আরাম পেতে হালকা উষ্ণতা ব্যবহার করতে পারেন।
  • মেনথল বা ডাইক্লোফেনাক সোডিয়ামযুক্ত মলম দিনে দুইবার প্রয়োগ করুন।
  • প্রয়োজনে প্যারাসিটামল সেবন করতে পারেন।

ডিক্লোমল ট্যাবলেট (Diclomol Tablet) সাধারণত গাঁটের ফোলাভাব এবং ব্যথা উপশমের জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি পেশী এবং হাড়ের সংযোগকারী টিস্যুতে ব্যথা ও ফোলাভাব কমাতে সাহায্য করে।

ডায়েটের মাধ্যমে ওজন কমানোর সময় প্রস্রাবের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে তা বেদনাদায়ক ক্র্যাম্পের কারণ হতে পারে। এর ফলে শরীর থেকে তরল এবং ইলেক্ট্রোলাইট হারিয়ে যায়, যা ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম এবং অন্যান্য খনিজগুলির ভারসাম্য বিঘ্নিত করে। এই অসামঞ্জস্য পায়ে ব্যথার কারণ হতে পারে। এছাড়া, ভিটামিন ই-এর ঘাটতিও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

সূর্যের বিষক্রিয়া সাধারণত পেশী ব্যথার কারণ হয় না, তবে এ দুটির মধ্যে একটি সম্পর্ক রয়েছে। তীব্র পানিশূন্যতা এবং তাপ ক্লান্তি পেশী ব্যথা বা অস্বস্তি সৃষ্টি করতে পারে। দীর্ঘক্ষণ সূর্যের তাপে থাকলে মারাত্মক ত্বকের পোড়া, ডিহাইড্রেশন এবং তাপ ক্লান্তি তিনটিই একসাথে দেখা দিতে পারে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart