ভেরিকোসিল থেকে মুক্তির উপায়, ব্যায়াম এবং এর ঘরোয়া চিকিৎসা

ভেরিকোসিল থেকে মুক্তির উপায়, ব্যায়াম এবং এর ঘরোয়া চিকিৎসা

ভেরিকোসিল একটি সাধারণ সমস্যা, যা পুরুষদের প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে। তবে, ভেরিকোসিল থেকে মুক্তির উপায় রয়েছে, বিশেষ করে ব্যায়াম এবং ঘরোয়া চিকিৎসা দিয়ে। নির্দিষ্ট ব্যায়াম যেমন কেগেল এক্সারসাইজ অণ্ডকোষের রক্ত সঞ্চালন উন্নত করতে সাহায্য করে এবং কিছু প্রাকৃতিক উপাদান যেমন হালকা ম্যাসাজ ভেরিকোসেলের উপসর্গ কমাতে পারে। এই ব্লগে আমরা আলোচনা করবো কীভাবে ব্যায়াম এবং ঘরোয়া চিকিৎসা ভেরিকোসেল থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করে।

ভেরিকোসিল কি?

ভেরিকোসিল কি?

ভেরিকোসিল হলো পুরুষদের অণ্ডকোষের শিরাগুলোর ফোলা বা প্রসারিত হয়ে যাওয়ার একটি সাধারণ সমস্যা, যা স্ক্রোটামে (অণ্ডকোষ রাখার থলি) দেখা যায়। এটি অনেকটা পায়ের ভেরিকোজ শিরার মতো, যেখানে শিরাগুলো ফোলাভাব নিয়ে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। সাধারণত রক্ত প্রবাহের সমস্যা এই অবস্থার কারণ, যেখানে শিরাগুলো ঠিকমতো কাজ না করায় রক্ত জমে যায় এবং চাপ সৃষ্টি করে। ভেরিকোসিল অনেক সময় উপসর্গহীন হতে পারে, তবে কিছু ক্ষেত্রে স্ক্রোটামে ভারী অনুভূতি, অস্বস্তি বা হালকা ব্যথা হতে পারে। এটি পুরুষের উর্বরতার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, কারণ শুক্রাণু উৎপাদন এবং মান কমে যেতে পারে।

ভেরিকোসিল কেন হয়?

ভেরিকোসিল কেন হয়?

ভেরিকোসিলের সঠিক কারণ এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, শুক্রাণু কর্ডে থাকা শিরাগুলোর ত্রুটিপূর্ণ ভালভ এটির প্রধান কারণ হতে পারে। সাধারণত, এই ভালভগুলো অণ্ডকোষ থেকে রক্ত ​​প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু যখন এই ভালভ ঠিকমতো কাজ করে না, তখন শিরাগুলোর ভেতরে রক্ত জমে যায় এবং সেগুলো ফুলে উঠে মোচড়ানো হয়ে যায়। এই অবস্থাকেই ভেরিকোসিল বলা হয়।

ভেরিকোসিল একটি সাধারণ সমস্যা, যা বিশ্বজুড়ে বহু পুরুষের মধ্যে দেখা যায়। এটি বেশিরভাগ সময় শৈশব বা কৈশোরে শুরু হয় এবং প্রায় ১৫ শতাংশ পুরুষ জীবনের কোনো এক সময়ে এই সমস্যায় আক্রান্ত হন। সাধারণত বাম অণ্ডকোষে এটি বেশি দেখা যায়, কারণ বাম দিকের শিরাগুলোর কাঠামো এবং রক্ত প্রবাহের দিক কিছুটা আলাদা। যদিও এটি তেমন গুরুতর নয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি অস্বস্তি, ভারী অনুভূতি বা মৃদু ব্যথার কারণ হতে পারে। ভেরিকোসিল পুরুষদের উর্বরতার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, কারণ এটি শুক্রাণুর মান এবং উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি করে। দীর্ঘদিন ধরে অবহেলা করলে এটি অণ্ডকোষের আকারে পরিবর্তন আনতে পারে।

ভেরিকোসিল এর লক্ষণ

ভেরিকোসিল এর লক্ষণ

ভেরিকোসিল হলো অণ্ডকোষের শিরাগুলো বড় হয়ে যাওয়ার একটি অবস্থা, যা ভ্যারিকোজ শিরার মতোই। এটি সাধারণত ব্যথাহীন হলেও, কিছু ক্ষেত্রে বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দিতে পারে লক্ষণগুলো নিচে দেওয়া হলো:

  • অণ্ডথলি মোটা হয়ে যাওয়া: অণ্ডকোষ বা অণ্ডথলি বড় এবং ভারী মনে হতে পারে।
  • হালকা ব্যথা: অণ্ডকোষে একধরনের বিরক্তিকর হালকা ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
  • ব্যথার বিস্তার: কুঁচকি থেকে পশ্চাৎ পিঠ পর্যন্ত ব্যথা ছড়াতে পারে।
  • অণ্ডকোষ ছোট হয়ে যাওয়া: শিশুকাল বা যৌবনের শুরুতে ভেরিকোসিল হলে অণ্ডকোষ আকারে ছোট হতে পারে।
  • ফোলাভাব: আক্রান্ত অণ্ডকোষ বা অণ্ডথলিতে ফোলাভাব দেখা দিতে পারে।
  • পিণ্ড অনুভব: কেউ কেউ অণ্ডকোষের উপর ছোট একটি পিণ্ডের মতো অনুভব করতে পারেন।
  • উর্বরতার সমস্যা: ভেরিকোসিলের কারণে সন্তান ধারণে সমস্যা হতে পারে, বিশেষত এক বছর চেষ্টা করার পরেও।

লক্ষণ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

  • ভেরিকোসিলের ব্যথা সাধারণত শুয়ে থাকলে কমে।
  • অনেক সময় এটি উপসর্গ ছাড়াই থাকে, তাই অনেক পুরুষ বুঝতে পারেন না যে তারা ভেরিকোসিলে আক্রান্ত।
  • কিছু ক্ষেত্রে এটি টেস্টিকুলার অ্যাট্রোফি (অণ্ডকোষের সংকুচিত হওয়া) এর কারণ হতে পারে।

ভেরিকোসিলের উপসর্গ দেখা দিলে বা সন্দেহ হলে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন। এটি সাধারণত গুরুতর না হলেও দীর্ঘমেয়াদে সমস্যার কারণ হতে পারে।

ভেরিকোসিল এর ব্যায়াম

ভেরিকোসিল এর ব্যায়াম

ভেরিকোসিলের সমস্যা কমাতে নিয়মিত কিছু সহজ ব্যায়াম ও অভ্যাস কার্যকর হতে পারে। প্রতিদিন ৩০ মিনিট দ্রুত হাঁটা বা ২০ মিনিট দৌড়ানো শরীরের রক্তপ্রবাহ উন্নত করতে সাহায্য করে। এছাড়া, ঘরে চিত হয়ে শুয়ে এয়ার সাইকেল ব্যায়াম করুন। যেখানে হাঁটু ভাঁজ করে বাতাসে সাইকেল চালানোর ভঙ্গিতে ১৫ মিনিট ব্যায়াম করবেন। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পায়ের আঙুলের ভর দিয়ে নিজেকে তুলুন, ১০ সেকেন্ড ধরে রাখুন এবং আগের অবস্থায় ফিরে আসুন। দিনে অন্তত ১০ বার এই ব্যায়াম করুন। পা ওপরে তোলা বা দেয়ালে ঠেকিয়ে রাখাও একটি উপায়, যা হৃৎপিণ্ডের সমতলে রক্তপ্রবাহ বাড়ায়। পায়ের পাতা ওপর-নিচে এবং ডানে-বাঁয়ে নেড়ে কয়েক সেকেন্ড ধরে রাখার ব্যায়াম দিনেও করা যেতে পারে।

সাঁতার, হাঁটা, বা মাঝারি তীব্রতার ব্যায়াম প্রতিসপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট করার চেষ্টা করুন। সুস্থ রক্তপ্রবাহ বজায় রাখতে পুষ্টিকর খাবার, বিশেষত ফল, সবজি, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার অভ্যাস করুন। হাইড্রেটেড থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দিনের শেষে কয়েকবার পা উঁচুতে তুলে রাখুন বা বালিশের ওপর শুয়ে বিশ্রাম নিন। ভেরিকোসিলের জন্য অস্ত্রোপচার করলে ভারী কাজ বা ব্যায়াম যেমন সাইকেল চালানো, জগিং, বা ওজন তোলা এড়িয়ে চলুন। নিয়মিত ব্যায়াম এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাস আপনাকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে।

ভেরিকোসিল থেকে মুক্তির উপায়

ভেরিকোসিল থেকে মুক্তির উপায়

ভেরিকোসিল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কয়েকটি চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। এগুলির মধ্যে জনপ্রিয় পদ্ধতি গুলো হচ্ছে –

এমবোলাইজেশন, যা একটি অ-সার্জিক্যাল পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে রেডিওলজিস্ট কুঁচকি বা ঘাড়ের শিরায় একটি ক্যাথেটার ঢুকিয়ে সমস্যাযুক্ত শিরাগুলো অবরুদ্ধ করেন। এর ফলে রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক শিরায় ফিরে আসে এবং অণ্ডকোষে ফোলাভাব ও ব্যথা কমে যায়। এমবোলাইজেশন হলো একটি অত্যন্ত নিরাপদ এবং দ্রুত ফলপ্রসূ চিকিৎসা, সাধারণত হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় না এবং রোগী দ্রুত বাড়ি ফিরে যেতে পারে।

অন্যদিকে, ভেরিকোসেলেকটমি হলো একটি অস্ত্রোপচার ভিত্তিক পদ্ধতি, যা অণ্ডকোষের ব্যথা কমানোর পাশাপাশি উর্বরতা বাড়াতে সাহায্য করে। এই পদ্ধতিতে শিরাগুলিকে সরিয়ে ফেলা হয় বা বন্ধ করে দেয়া হয়, ফলে রক্ত প্রবাহ সুস্থ শিরায় চলে যায় এবং শুক্রাণুর গুণমান উন্নত হয়। এই পদ্ধতির মাধ্যমে ভেরিকোসিলের কারণে যেসব পুরুষ প্রজনন সমস্যায় ভুগছেন, তাদের জন্য এটি অত্যন্ত কার্যকর।

সবচেয়ে আধুনিক এবং কার্যকর পদ্ধতি হলো মাইক্রোসার্জিক্যাল ভেরিকোসেলেকটমি। এতে অত্যাধুনিক মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করে খুব সূক্ষ্ম অস্ত্রোপচার করা হয়, যার মাধ্যমে ভেরিকোসিলের পুনরাবৃত্তি হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যেতে চলে আসে। এই পদ্ধতিতে রোগী মাত্র এক দিনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়  এবং পরবর্তী কয়েক দিনের মধ্যেই সেরে উঠেন।

ভেরিকোসিল মূলত অণ্ডকোষের শিরাগুলোর সম্প্রসারণের কারণে ঘটে, যার ফলে ব্যথা, অস্বস্তি এবং ফোলাভাব সৃষ্টি হয়। তবে সঠিক সময়ে উপযুক্ত চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে সহজেই এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। চিকিৎসা পদ্ধতিগুলি দ্রুত আরোগ্য লাভে সাহায্য করে এবং রোগীকে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।

ভেরিকোসিল এর ঘরোয়া চিকিৎসা

ভেরিকোসিল এর ঘরোয়া চিকিৎসা

ভেরিকোসিলের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি বেশ কার্যকর। অণ্ডকোষে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য আরামদায়ক জকস্ট্র্যাপ বা ব্রিফস ধরনের অন্তর্বাস পরুন। দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকলে অস্বস্তি বাড়তে পারে, তাই মাঝে মাঝে পিঠে শুয়ে বিশ্রাম নিন। ব্যথা কমাতে অ্যাসিটামিনোফেন বা আইবুপ্রোফেনের মতো ব্যথানাশক ওষুধ ব্যবহার করতে পারেন। অণ্ডকোষে বরফ বা ঠান্ডা প্যাক প্রয়োগ করলে ব্যথা ও ফোলাভাব কমে। ভারী কাজ এবং চাপ সৃষ্টিকারী কার্যকলাপ এড়িয়ে চলুন। বিশেষ করে, ব্যায়ামের সময় টাইট ফিটিং অন্তর্বাস না পরে আরামদায়ক পোশাক পরার চেষ্টা করুন।

দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা বা অস্বস্তির জন্য টেন্স থেরাপি বা ইলেকট্রিক থেরাপি মেশিন ব্যবহার অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে। টেন্স থেরাপি হালকা বৈদ্যুতিক প্রবাহ দিয়ে স্নায়ুকে শিথিল করে ব্যথা কমায়, আর ইলেকট্রিক থেরাপি পেশী শিথিল ও রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়। এগুলো শুধু শারীরিক আরাম নয়, মানসিক প্রশান্তিও প্রদান করে। আঘাত, সার্জারি, বা অতিরিক্ত স্ট্রেসের কারণে ক্লান্ত শরীরকে পুনরায় চাঙ্গা করতে এই মেশিনগুলো কার্যকর। সহজে ব্যবহারযোগ্য এই যন্ত্রগুলো আপনার ব্যথা কমিয়ে জীবনকে আরও সহজ করে তোলে। তবে সমস্যা বেশি হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

 

বিস্তারিত জানুন: ঘাড়ের রগ ব্যথা কারণ | ঘাড়ের রগের ব্যথা সারানোর উপায় কি?

সচরাচর সকলে যে প্রশ্ন গুলো করে থাকেন

হ্যাঁ, ভেরিকোসেল থাকলেও বিয়ে করা সম্ভব। তবে ভেরিকোসেলের রোগীদের নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

না, ভেরিকোসেল থাকলে ফুটবল খেলা উচিত নয়। ভেরিকোসেলে আক্রান্ত যুবকদের খেলাধুলা এড়িয়ে চলা উচিত, কারণ এটি শুক্রাণুর গুণমান উন্নত করতে সহায়ক হতে পারে। অতিরিক্ত শারীরিক চাপ ভেরিকোসেলের অবস্থা আরও খারাপ করতে পারে।

একবার ভেরিকোসিল হলে এটি নিজে থেকে সেরে ওঠে না। সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমেই এটি নিরাময় সম্ভব, এবং কিছু ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারও প্রয়োজন হতে পারে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart